অনেক আগেকার কথা।সেই ছোটো বেলা মা-বাবা হারিয়ে বাঁচার তাগিদে সব কিছু ফেলেরেখে বাড়ি ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে আসি নওয়াপাড়ায়। কোথায় থাকবো কি খাবো জানিনা? হাতে কোনো পয়সা কড়ি নেই যে, কিছু কিনে খাবো? রেলস্টেশনে হলো ঠাই। ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হয়নি দেশ। চারিদিকে শুধু হতাশা আর হতাশা।
এমন সময় শীতের আগমন। গায়ে পরিধান করার মতো কোনো শীত বস্ত্র ছিলো না। হাটতে হাটতে তখন বেঙ্গল অভিমুখে যাওয়ার পথিমধ্যে টিএ সাহেব দের পলের পালা ( বিছালীর স্তুপ) দেখতে পেয়ে ওখানেই রাত কাটাতে লাগলাম।
বিধিবাম সেই আরামের বিছানায় হঠাৎ করে বাঁধ সাধলো টিএ সাহেব দের বাড়ির কুত্তা। রাতে একদা কামড়িয়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো আমার শরীর। সকালে লোকজনের করুনায় ঠাঁই হলো পীর সাহেব হুজুরের মাদ্রাসায়। তখন অত্র অঞ্চলে পীর সাহেব হুজুরের মাদ্রাসা ছিলো স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ।
কুকুর এক্ষেত্রে ক্ষতির পাশাপাশি উপকার করলো মন্দ না। যাহোক পথে ভেসে বেড়ানোর একটা অবসান ঘটিয়ে মাদ্রাসায় থাকা খাওয়া পড়াশোনার একটা ব্যাবস্থা হলো। কিছু দিন পরে লজিং এর একটা ব্যাবস্থা হলো নর্থ বেঙ্গল রোডের আকাম- মোকামদের বাসায়।
এভাবে জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। পীর সাহেব হুজুরের দোয়ার বরকতে ততকালীন খুবই প্রভাবশালী ইসমাইল মেম্বারের বড়ো কন্যাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। বাজারে শশুরের চালের ব্যাবসা দেখাশুনার দায়িত্ব পেলাম। সুখ বেশি দিন সইলো না।
ভাগ্য বিড়ম্বনাদের হয়তো এমনই হয়। বেঙ্গল মিল তৈরি হলো জয়েন্ট করলাম সেখানে। সালটা ১৯৬৩। বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু। নতুন ভাবে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। কিছু দিন পরে শুরু হলো দেশ স্বাধীনের যুদ্ধ। পাকিস্তানী আর্মি রা মিল থেকে বাহির করে দিলো। পরিবার নিয়ে এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। যুদ্ধ শেষ হলো দেশ স্বাধীন হলো পুনরায় চাকরি ফিরে পেলাম।
চাকরিতে আর সুবিধা করতে পারছিলাম না। আশির দশকের শুরু তে চাকরি ছেড়ে জনৈক প্রভাবশালীর নিকট চাকরি ছাড়া টাকা দিয়ে একটু সুখে থাকতে চেয়েছিলাম সেখানেও নিয়তি বাধ সাধলো। কিছু দিন পরে ঘাড় ঘুল্লি খেয়ে সেই পথের ভিখিরির খাতায় নাম লেখালাম।
এখন তো চার সন্তানের বড়ো পরিবার নিয়ে নিদারুন কষ্টে দুঃখে পথে ভাসতে থাকলাম। ঠাই পেলাম খালেক মিনেদের বাঁশ তলায় আর কলাতলা মসজিদের ( নওয়াপাড়া বায়তুর রাহমান জামেমসজিদ) মুয়াজ্জিন হিসেবে। গায়ে খেটে মসজিদের খেদমত করা আর মানুষের বাড়িতে মেলাদ পড়িয়ে জীবন চলতো।
বছরে সবে বরাতের সময় প্রায় সকল বাড়িতে আমি আর রুহুল হুজুর মেলাদ পড়াতাম। তখন এতোবেশি হুজুরের অভাব ছিলো। মানুষের বাড়িতে আরবি পড়ানোর সুবাদে ওস্তাদী বলে লোকে সম্বোধন করতো। আমৃত্যু মসজিদের খেদমত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বয়সের বিড়ম্বনার শিকার হয়ে একটা সময় মসজিদ ছাড়তে হয়েছে।
আমি আর আমার মিতে ( শফি মুন্সি) দুজনের মধ্যে পাল্লা চলতো আযান দেওয়া নিয়ে। মিতে আমাকে অনেক উপকার করেছে। সৌভাগ্য মিতের জানাজা আমি পড়তে পেরেছি। কিন্তু আমার জানাজা আমার প্রাণের মসজিদ কমিটির লোকজন পড়তে পারিনি। আমাদের নাম গন্ধ নেওয়ার মতো কেউ থাকবে না বাবা।
দোয়া দেওয়া ছাড়া কিছুইতো তোমাদের দিতে পারলাম না। তবে আল্লাহ কখনো তোমাদের কষ্টে রাখবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই দুনিয়াতে তোমাদের কে উত্তম প্রতিদান দেবে। আমার সময় সীমিত আমি দ্রুত পারি জমাবো। আমার জন্য তোমার মায়ের জন্য দোয়া করবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। অসংখ্য মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি তাই মানুষের সহযোগিতা করবে।
ওয়াদা খেলাফ করবে না আমানতের খেয়ানত করবে না। আল্লাহ তোমাকে সর্বোচ্চ সন্মানের স্থানে নিয়ে যাবে। বাবা তোমার জন্য আমৃত্যু দোয়া রইলো।
বাবা তুমি আজ আমাদের মাঝে নেই রয়েছে তোমার অফুরন্ত দোয়ার ভান্ডার। আর কখনো বাবা বলে ডাকতে পারবো না। আল্লাহ তুমি পৃথিবীর সকল বাবাদের জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে স্থান দান করো। আমীন। আমীন। আমীন।
লেখকঃ শেখ এম এ জলিল
ঠিকানাঃ ২নং ওয়ার্ড নওয়াপাড়া অভয়নগর যশোর।
Leave a Reply