কে,এম,মোজাপ্ফার হুসাইন
গ্রামের সবার কাছে তিনি প্রিয় ‘রস কাকা’। সবাই এই নামে চিনলেও তাঁর কিতাবি নাম মাওলানা কাজী ফারুক হোসেন (৬০)। পেশায় শিক্ষক। যশোরের যশ, খেজুরের রস—এই সুখ্যাতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় রীতিমতো সংগ্রামে নেমেছেন তিনি। ভোরের হাড় কাঁপানো শীতকে ভুলে এই মানুষটি গাছে উঠে খেজুরের রস সংগ্রহ করেন। নিজেই সেই রসের ভাঁড় কাঁধে নিয়ে নিজ গ্রামসহ আশপাশের মানুষদের পর্যায়ক্রমে বিলিয়ে দেন।
৬ বছর ধরে এই কাজ করে তিনি আনন্দে মাতছেন। এর জন্য কাজী ফারুক কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন না। এমনকি রস সংগ্রহ করার ভাঁড়সহ অন্যান্য উপকরণও কেনেন নিজ পকেটের টাকায়। নিরাপদে পান করার উপযোগী রস সংগ্রহ করতে গাছে ভাঁড়ের ওপর খাঁচা লাগানোর ব্যবস্থাও করেন তিনি। যশোরের সুস্বাদু খেজুরের রস ও গুড় টিকিয়ে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে অভিনব এই উদ্যোগ কাজী ফারুক হোসেনের।
যশোরের বাঘারপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম বহরমপুরে তাঁর বাস। প্রতি শীত মৌসুমে ৬০/৭০টি খেজুরগাছ নিজ হাতে কাটেন। তাঁর দুই ছেলে নাজমুস সাকিব ও মাহবুব হেলাল এবং এক মেয়ে উম্মে হাবিবা ও তার পুত্রবধূ তাঁর এই শুভ কাজের সহযোগী। ফারুক হোসেনের ইচ্ছা আগামীতে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন গ্রামে দক্ষ ‘গাছি’ তৈরি করা।
ভোরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনেই গ্লাস, মগ, কাপ, ছোট ঘটি, বোতল নিয়ে অপেক্ষমাণ একদল শিশু-কিশোর। খেজুরের রস পান করতেই এসেছে সবাই। ফারুক হোসেন খাঁটি খেজুরের রস নিয়ে মাঠ থেকে ফিরবেন সেই অপেক্ষাতেই তারা। একপর্যায়ে শিশুদের দলবদ্ধ আনন্দ-চিৎকারে বোঝা গেল তিনি আসছেন। হল্লা-চিল্লা করে শিশুরদল তাঁকে ঘিরে ধরে তাঁর সঙ্গে ঢুকল বাড়িতে। এরপর তিনি ছাঁকার জন্য রসভর্তি ভাঁড়ের মুখে পরিষ্কার কাপড় বাঁধলেন। শুরু হলো শিশুদের হুড়াহুড়ি, কে কার আগে রস পান করবে। তা দেখে তিনি বিরক্ত তো হলেনই না, বরং এসব দেখে আনন্দ আর মুগ্ধতার ঝিলিক ফুটল মানুষটির মুখে।
কাজী ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমার এই কাজের পেছনে অবশ্যই উদ্দেশ্য আছে। সেটা হলো, বেশ কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি যশোরের খেজুর রস ও গুড়ের যে ঐতিহ্য তা দিন দিন বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। এমনকি গ্রামেও এখন ভালো মানের রস পাওয়াটাও দুর্লভ। এর অন্যতম কয়েকটি কারণ হলো, খেজুরগাছ কমে যাওয়া। আবার যে সংখ্যক খেজুরগাছ আছে তার অধিকাংশই রস সংগ্রহ করতে কাটা হয় না দক্ষ গাছির অভাবে। কিন্তু সুস্বাদু রস পান করতে সবাই আগ্রহী।’
এ ব্যাপারে কথা হয় শিশুপুত্র নিয়ে খেজুর রস পান করতে আসা অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, “‘রস কাকা’ আমাদের ফ্রি খেজুরের রস খাওয়ান। গ্রামেও এখন খাঁটি রস পাওয়া কঠিন। কিন্তু ফারুক কাকার জন্যি আমাদের গ্রামের বাচ্চারা রস খাতি পারে। আমরাও খাঁটি রস খাচ্ছি। আবার এর জন্যি তিনি কোনো টাকা-পয়সা নেন না।” গ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, ‘তিনি তিন বছর শীতকালে গ্রামের খেজুরগাছ নিজে কাটেন। এই রস গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করেন। তিনি টাকার জন্য এই গাছ কাটেন না। তিনি এই অঞ্চলের খেজুরের রস ও গুড়ের পুরনো দিন ফিরিয়ে আনতে, টিকিয়ে রাখতে, মানুষের সেবার জন্য এই খেজুর গাছ কেটে খাঁটি রস মানুষদের খাওয়ান।’
তিনি এলাকার মানুষের জন্য কবর স্থানের জন্য নিজের জমি দান করেছেন।
রাস্তারপাশে প্রায় ৮ হাজার তালের চারাও রোপন করেছেন ফারুক হোসেন।