আশিকুর রহমান,নেত্রকোনা প্রতিনিধিঃ
বাংলার বিলুপ্তপ্রায় লোকজ ঐতিহ্যকে পুনরায় তুলে ধরার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে নেত্রকোণায় ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমি সাতদিন ব্যাপী লোকজ মেলার আয়োজন করেছিল। আজ ২৯শে ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) মেলার শেষদিন। গত ২৩শে ডিসেম্বর (শুক্রবার) মেলাটি উদ্বোধন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান।
নেত্রকোণা ও বেশ কয়েকটি জেলায় কলেজটির সাংস্কৃতিক ফোরামের প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভা কমিটি রয়েছে। সাতদিনে কমিটিগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলো যৌথভাবে একেকদিন করে পরিবেশনা ভাগ করে নিয়েছে। কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে প্রতি রাতে একটি করে মঞ্চ নাটক ও দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বলতে বাঙালির ঐতিহ্য বাউল গান ছাড়াও ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি, কিচ্ছা গান, মালজোড়া গান, রাখালী গান এবং ঘেটু গানসহ প্রভৃতি ইভেন্ট ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। জানা যায়, সাতদিনে নেত্রকোণার পৌরসভাসহ ৮৬টি ইউনিয়নের সহস্রাধিক শিল্পীর মধ্য থেকে প্রতিভাবান অখ্যাত ৪৫০জন শিল্পীকে মঞ্চে পরিবেশন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইভেন্টে বিজ্ঞ বিচারকদের মাধ্যমে যাচাই করে সেরাদের আলাদাভাবে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রতিদিন একজন করে দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রধান অতিথি থাকছেন।
মেলায় বিভিন্ন ধরণের স্টলও বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া নাগরদোলা, কাপড়চোপড় ও বিভিন্ন তৈজসপত্রের দোকানও উল্লেখযোগ্য।
নাটক দ্বারা কি মেসেজ দিতে চাচ্ছেন জানতে চাইলে নবাব সিরাজুদ্দৌলা নাটকের নায়ক জহিরুল ইসলাম খান জুয়েল বলেন, “নাটকটি দ্বারা বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার গুরুত্ব এবং এর স্বাদ কি তার মনোবৃত্তি বুঝানোর চেষ্টা করছি।”
কলেজের সাংস্কৃতিক ফোরামের লক্ষীপুর ইউনিয়নের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক মোঃ মানিক মিয়া বলেন, “লোকসংস্কৃতি আমাদের দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে ছিল। এই মেলাটা আমাদের সমাজের জন্য, আমাদের রাষ্ট্রের জন্য একটা বড় ধরণের মেসেজ। এই মেসেজটা সমাজ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। এবং এই মেলাটা যদি ভবিষ্যতে চলতে থাকে তাহলে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও বিনোদন জগতের মহা পরিবর্তন আসবে।”
সাংবাদিক মোশারফ হোসেন জসিম পাঠান বলেন, “এই মেলাটি নেত্রকোণা তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহে সাংস্কৃতিক জগতে একটি বিশেষ অবদান রাখবে।”
ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমির সংগীত বিভাগের শিক্ষিকা এবং বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী রাজলক্ষ্মী সরকার বলেন, “আমাদের লোকসংস্কৃতি বিলুপ্ত প্রায়। আমরা এই মেলার মাধ্যমে চেষ্টা করছি আমাদের লোকজ যে ঐতিহ্য তা তুলে ধরার এবং লোকজ যে সরঞ্জামাদি তা বিভিন্ন স্টলের মাধ্যমে উপস্থাপন করার।”
নাট্যকার ও মানবাধিকার কর্মী লালচাঁন ফকির বলেন, “নাটক হলো সমাজ গড়ার হাতিয়ার। নাটকের মাধ্যমে আমরা সমাজের বিষয়গুলো তুলে ধরি।”
মেলায় প্রথমদিন থেকে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক এআইজি বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা জনাব মালিক খসরু পিপিএম এঁর কাছে এই মেলার প্রভাবটা কি হবে জানতে চাইলে তিনি হ্যালোকে বলেন, একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনা- যেটা বাংলাদেশের সৃষ্টিতে আমরা দেখেছি। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে- মেলায় যারা যারা আসছেন প্রত্যেকেই কিন্তু এটাকে লালন করছেন। এই লালন করাটাকে সর্বস্তরে পৌছিয়ে দেওয়ার জন্য এই মেলা একটা বিশাল অবদান রাখবে।
লোকজ মেলা করার উদ্যেশ্য জানতে চাইলে ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল হাসান তপু হ্যালোকে বলেন, “নেত্রকোণা লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ একটি এলাকা। হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কাহ্নপাদ নামে একজন কবি ছিলেন। তাঁর কবিতা এখানটায় আছে। নেপাল রাজপ্রসাদ থেকে যে চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয়েছিল অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত যে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তার প্রতিটাই হলো জন মানুষের সংস্কৃতি। মানুষের হৃদয় নিঃসৃত এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাসই লোকজ সংস্কৃতি।”
লোকজ পণ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “আমাদের এখানটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য উপাদান। যেটা অন্যান্য অঞ্চলে নেই। হাওর-পাহাড় বেষ্টিত নেত্রকোণা জেলায় সমৃদ্ধ একটা জেলা। আমরা এই পণ্যগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য লোকজ সংগ্রহশালা করেছি।” তপু আরো বলেন, “এখানে হুমায়ুন আহমেদ আছেন, নির্মলেন্দু গুণ আছেন, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল আছেন, বাউল সম্রাট রশিদ উদ্দীন, জালাল খাঁ, উকিল মুন্সি, বারী সিদ্দিকীসহ প্রমুখ। এই অঞ্চলে অপরিচিত আরো অসংখ্য প্রতিভাবান রয়েছে। তাঁদের প্লাটফর্ম করে দেওয়া ও সমৃদ্ধ নেত্রকোণার হাজার বছরের সংস্কৃতি তুলে ধরায় লোকজ মেলার উদ্দেশ্য।”
লোকজ মেলায় ঘুরতে আসা সাধারণ দর্শকদের মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বহুদিনপর পরিচিতদের সাথে দেখা হয়ে তাদের আবেগাপ্লুত অনুভূতি ও বিচিত্র মেলা দর্শনে বাধঁভাঙা উচ্ছ্বাস দেখা যায়।
Leave a Reply